Saturday, April 19, 2014

শিক্ষকের মর্যাদা - কাজী কাদের নেওয়াজ

শিক্ষকের মর্যাদা
 - কাজী কাদের নেওয়াজ
=====================
বাদশাহ আলমগীর-
কুমারে তাঁহার পড়াইত এক মৌলভী দিল্লীর।
একদা প্রভাতে গিয়া
দেখেন বাদশাহ- শাহজাদা এক পাত্র হস্তে নিয়া
ঢালিতেছে বারি গুরুর চরণে
পুলকিত হৃদে আনত-নয়নে,
শিক্ষক শুধু নিজ হাত দিয়া নিজেরি পায়ের ধুলি
ধুয়ে মুছে সব করিছেন সাফ্ সঞ্চারি অঙ্গুলি।
শিক্ষক মৌলভী
ভাবিলেন আজি নিস্তার নাহি, যায় বুঝি তার সবি।
দিল্লীপতির পুত্রের করে
লইয়াছে পানি চরণের পরে,
স্পর্ধার কাজ হেন অপরাধ কে করেছে কোন্ কালে!
ভাবিতে ভাবিতে চিন্তার রেখা দেখা দিল তার ভালে।
হঠাৎ কি ভাবি উঠি
কহিলেন, আমি ভয় করি না’ক, যায় যাবে শির টুটি,
শিক্ষক আমি শ্রেষ্ঠ সবার
দিল্লীর পতি সে তো কোন্ ছার,
ভয় করি না’ক, ধারি না’ক ধার, মনে আছে মোর বল,
বাদশাহ্ শুধালে শাস্ত্রের কথা শুনাব অনর্গল।
যায় যাবে প্রাণ তাহে,
প্রাণের চেয়েও মান বড়, আমি বোঝাব শাহানশাহে।

তার পরদিন প্রাতে
বাদশাহর দূত শিক্ষকে ডেকে নিয়ে গেল কেল্লাতে।
খাস কামরাতে যবে
শিক্ষকে ডাকি বাদশা কহেন, ”শুনুন জনাব তবে,
পুত্র আমার আপনার কাছে সৌজন্য কি কিছু শিখিয়াছে?
বরং শিখেছে বেয়াদবি আর গুরুজনে অবহেলা,
নহিলে সেদিন দেখিলাম যাহা স্বয়ং সকাল বেলা”
শিক্ষক কন-”জাহপানা, আমি বুঝিতে পারিনি হায়,
কি কথা বলিতে আজিকে আমায় ডেকেছেন নিরালায়?”
বাদশাহ্ কহেন, ”সেদিন প্রভাতে দেখিলাম আমি দাঁড়ায়ে তফাতে
নিজ হাতে যবে চরণ আপনি করেন প্রক্ষালন,
পুত্র আমার জল ঢালি শুধু ভিজাইছে ও চরণ।
নিজ হাতখানি আপনার পায়ে বুলাইয়া সযতনে
ধুয়ে দিল না’ক কেন সে চরণ, স্মরি ব্যথা পাই মনে।”

উচ্ছ্বাস ভরে শিক্ষকে আজি দাঁড়ায়ে সগৌরবে
কুর্ণিশ করি বাদশাহে তবে কহেন উচ্চরবে-
”আজ হতে চির-উন্নত হল শিক্ষাগুরুর শির,
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশাহ্ আলমগীর।”

মানুষ কে? - ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

মানুষ কে?
 - ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
======================
নিয়ত মানসধামে একরূপ ভাব।
জগতের সুখ-দুখে সুখ দুখ লাভ।।
পরপীড়া পরিহার, পূর্ণ পরিতোষ।
সদানন্দে পরিপূর্ণ স্বভাবের কোষ।।
নাহি চায় আপনার পরিবার সুখ।
রাজ্যের কুশলকার্যে সদা হাস্যমুখ।।
কেবল পরের হিতে প্রেম লাভ যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?

নাহি চায় রাজ্যপদ নাহি চায় ধন।
স্বর্গের সমান দেখে বন উপবন।।
পৃথিবীর সমুদয় নিজ পরিজন।
সন্তোষের সিংহাসনে বাস করে মন।।
আত্মার সহিত সব সমতুল্য গণে।
মাতাপিতা জ্ঞাতি ভাই ভেদ নাহি মনে।।
সকলে সমান মিত্র শত্রু নাহি যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?

অহংকার-মদে কভু নহে অভিমানী।
সর্বদা রসনারাজ্যে বাস করে বাণী।।
ভুবন ভূষিত সদা বক্তৃতার বশে।
পর্বত সলিল হয় রসনার রসে।।
মিথ্যার কাননে কভু ভ্রমে নাহি ভ্রমে।
অঙ্গীকার অস্বীকার নাহি কোন ক্রমে।।
অমৃত নিঃসৃত হয় প্রতি বাক্যে যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?

চষ্টা যত্ন অনুরাগ মনের বান্ধব।
আলস্য তাদের কাছে রণে পরাভব।।
ভক্তিমতে কুশলগণে আয় আয় ডাকে।।
পরিশ্রম প্রতিজ্ঞার সঙ্গে সঙ্গে থাকে।
চেষ্টায় সুসিদ্ধ করে জীবনের আশা।
যতনে হৃদয়েতে সমুদয় বাসা।।
স্মরণ স্মরণ মাত্রে আজ্ঞাকারী যার।
মানুষ তারেই বলি মানুষ কে আর?

কে? - ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

কে?
 - ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
==================
বল দেখি এ জগতে ধার্মিক কে হয়,
সর্ব জীবে দয়া যার, ধার্মিক সে হয়।
বল দেখি এ জগতে সুখী বলি কারে,
সতত আরোগী যেই, সুখী বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে বিজ্ঞ বলি কারে,
হিতাহিত বোধ যার, বিজ্ঞ বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে ধীর বলি কারে,
বিপদে যে স্থির থাকে, ধীর বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে মূর্খ বলি কারে,
নিজ কার্য নষ্ট করে, মূর্খ বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে সাধু বলি কারে,
পরের যে ভাল করে, সাধু বলি তারে।
বল দেখি এ জগতে জ্ঞানী বলি কারে,
নিজ বোধ আছে যার জ্ঞানী বলি তারে।

তপসে মাছ - ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

তপসে মাছ
- ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
=====================
কষিত-কনককান্তি কমনীয় কায়।
গালভরা গোঁফ-দাড়ি তপস্বীর প্রায়॥
মানুষের দৃশ্য নও বাস কর নীরে।
মোহন মণির প্রভা ননীর শরীরে॥
পাখি নও কিন্তু ধর মনোহর পাখা।
সমধুর মিষ্ট রস সব-অঙ্গে মাখা॥
একবার রসনায় যে পেয়েছে তার।
আর কিছু মুখে নাহি ভাল লাগে তার॥
দৃশ্য মাত্র সর্বগাত্র প্রফুল্লিত হয়।
সৌরভে আমোদ করে ত্রিভুবনময়॥
প্রাণে নাহি দেরি সয় কাঁটা আঁশ বাছা।
ইচ্ছা করে একেবারে গালে দিই কাঁচা॥
অপরূপ হেরে রূপ পুত্রশোক হরে।
মুখে দেওয়া দূরে থাক গন্ধে পেট ভরে॥
কুড়ি দরে কিনে লই দেখে তাজা তাজা।
টপাটপ খেয়ে ফেলি ছাঁকাতেলে ভাজা॥
না করে উদর যেই তোমায় গ্রহণ।
বৃথায় জীবন তার বৃথায় জীবন॥
নগরের লোক সব এই কয় মাস।
তোমার কৃপায় করে মহা সুখে বাস॥

মাতৃভাষা - ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত

মাতৃভাষা
- ঈশ্বরচন্দ্র গুপ্ত
=================
মায়ের কোলেতে শুয়ে              ঊরুতে মস্তক থুয়ে
খল খল সহাস্য বদন।
অধরে অমৃত ক্ষরে              আধ আধ মৃদু স্বরে
আধ আধ বচনরচন।।
কহিতে অন্তরে আশা              মুখে নাহি কটু ভাষা
ব্যাকুল হয়েছে কত তায়।
মা-ম্মা-মা-মা-বা-ব্বা-বা-বা   আবো আবো আবা আবা
সমুদয় দেববাণী প্রায়।।
ক্রমেতে ফুটিল মুখ              উঠিল মনের সুখ
একে একে দেখিলে সকল।
মেসো, পিসে, খুড়ো, বাপ              জুজু, ভুত, ছুঁচো, সাপ
স্থল জল আকাশ অনল।।
ভাল মন্দ জানিতে না,               মল মুত্র মানিতে না,
উপদেশ শিক্ষা হল যত।
পঞ্চমেতে হাতে খড়ি,               খাইয়া গুরুর ছড়ি,
পাঠশালে পড়িয়াছ কত।।
যৌবনের আগমনে,               জ্ঞানের প্রতিভা সনে,
বস্তুবোধ হইল তোমার।
পুস্তক করিয়া পাঠ,               দেখিয়া ভবের নাট,
হিতাহিত করিছ বিচার।।
যে ভাষায় হয়ে প্রীত              পরমেশ-গুণ-গীত
বৃদ্ধকালে গান কর মুখে।
মাতৃসম মাতৃভাষা              পুরালে তোমার আশা
তুমি তার সেবা কর সুখে।।

হে সময়, অশ্বারোহী হও - পুর্ণেন্দু পত্রী

হে সময়, অশ্বারোহী হও
 - পুর্ণেন্দু পত্রী
=================
বিরক্ত নদীর মতো ভুরু কুঁচকে বসে আছে আমাদের কাল।
যাচ্ছি যাব, যাচ্ছি যাব এই গড়িমসি করে চূড়ো ভাঙা চাকা ভাঙা রথ
যে রকম ঘাড় গুজে ধুলোয় কাতর, সে রকমই শুয়ে বসে আছে।
খেয়াঘাটে পারাপার ভুলে-যাওয়া, নৌকার মতন, সময় এখন।

মনে হয় সময়ের পায়ে ফুটে গেছে দীর্ঘ পেরেক বা মনসার কাঁটা
ছিড়ে গেছে স্ম্যান্ডেলের স্ট্র্যাপ কিংবা জুতোর গোড়ালি
মনে হয় তার সব কোটপ্যান্ট ধোবার ভাটিতে
হয়তো বা কোনও এক লোকাল ট্রেনের হু হু ভিড়ে
চুরি হয়ে গেছে পার্স, পার্সে ছিল অগ্রিম টিকিট।

প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নিয়ে যাবে পাহাড়ের সোনালী চূড়োয়
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে আকাশের সিথি থেকে সিদুরের টিপ এনে দেবে
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে নক্ষত্রের ক্যামেরায় ছবি তুলে উপহার দেবে অ্যলবাম
প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলে কলকাতায় এন দেবে শঙ্খের সাগর।

প্রতিশ্রুতি যত্রতত্র ছড়াবার ছিটোবার কথ, থুতু, মলমুত্র নয়
প্রতিশ্রুতি লাল নীল পতাকার ব্যতিব্যস্ত ওড়াউড়ি নয়
প্রতিশ্রুতি প্রেসনোট, দৈববাণী, দেয়ারের লিপিচিত্র নয়।
প্রতিশ্রুতি শীতের চাদর
প্রতিশ্রুতি ভাঙা চালে খড়
প্রতিশ্রুতি সাদা ভাত, ভাতে দুধ, দুধে ঘন সর
প্রতিশ্রুতি চেতনার স্তরে স্তরে সপ্তসিন্ধুজলের মর্মর।

হে সময়, হে বিকলাঙ্গ বিভ্রান্ত সময়
কানা কুকুরের মতো এটো-কাটা ঘাঁটাঘাঁটি ভুলে
পৃথিবীর আয়নায় মুখ রেখে জামা জুতো পরে
সূর্যের বল্লম হাতে, একবার অশ্বারোহী হও।

সেই গল্পটা - পুর্ণেন্দু পত্রী

সেই গল্পটা
- পুর্ণেন্দু পত্রী
======================
আমার সেই গল্পটা এখনো শেষ হয়নি।
শোনো।
পাহাড়টা, আগেই বলেছি
ভালোবেসেছিলো মেঘকে
আর মেঘ কি ভাবে শুকনো খটখটে পাহাড়টাকে
বানিয়ে তুলেছিল ছাব্বিশ বছরের ছোকরা
সে তো আগেই শুনেছো।

সেদিন ছিলো পাহাড়টার জন্মদিন।
পাহাড় মেঘকে বললে
– আজ তুমি লাল শাড়ি পরে আসবে।
মেঘ পাহাড়কে বললে
– আজ তোমাকে স্নান করিয়ে দেবো চন্দন জলে।

ভালোবাসলে নারীরা হয়ে যায় নরম নদী
পুরুষেরা জ্বলন্ত কাঠ।
সেইভাবেই মেঘ ছিল পাহাড়ের আলিঙ্গনের আগুনে
পাহাড় ছিলো মেঘের ঢেউ-জলে।
হঠাৎ,
আকাশ জুড়ে বেজে উঠলো ঝড়ের জগঝম্প
ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে ছিনতাই এর ভঙ্গিতে ছুটে এল
এক ঝাঁক হাওয়া
মেঘের আঁচলে টান মেরে বললে
– ওঠ্‌ ছুঁড়ি! তোর বিয়ে ।

এখনো শেষ হয়নি গল্পটা।
বজ্রের সঙ্গে মেঘের বিয়েটা হয়ে গেলো ঠিকই
কিন্তু পাহাড়কে সে কোনোদিন ভুলতে পারলনা।
বিশ্বাস না হয় তো চিরে দেখতে পারো
পাহাড়টার হাড়-পাঁজর,
ভিতরে থৈথৈ করছে
শত ঝর্ণার জল।

তুমি এলে - পূর্ণেন্দু পত্রী

তুমি এলে
- পূর্ণেন্দু পত্রী
==================
তুমি এলে সূর্যোদয় হয়।
পাখি জাগে সমুদ্রের ঘাটে
গন্ধের বাসরঘর জেগে ওঠে উদাসীন ঘাসের প্রান্তরে
হাড়ের শুষ্কতা, ভাঙা হাটে।

তুমি এলে চাঁদ ওঠে চোখে
সুস্বাদু ফলের মতো পেকে পরিপূর্ণ হয়
ইচ্ছা, প্রলোভন,
ঘরের দেয়াল ভেঙে ঘরে ঢুকে পড়ে দুর
ভ্রমনের বন।

তুমি এলে মেঘ বৃষ্টি সবই মুল্যবান।
আমাদের কাঠের চেয়ার
যেদিকে শহর নেই, শ্রাবণের মেঘমল্লার
মাতাল নৌকার মতো ভেসে যায় ভবিষ্যৎহীন।
পৃথিবী পুরনো হয়
পৃথিবীর ছাইগাদা, ছন্নছাড়া দৃশ্যের বিভুঁয়ে
শতাব্দীর শোক-তাপ জ্বর-জালা ছুঁয়ে
রয়ে যাই আমরা নবীন।

সরোদ বাজাতে জানলে - পূর্ণেন্দু পত্রী

সরোদ বাজাতে জানলে
 - পূর্ণেন্দু পত্রী

আমার এমন কিছু দুঃখ আছে যার নাম তিলক-কামোদ
এমন কিছু স্মৃতি যা সিন্ধুভৈরবী
জয়জয়ন্তীর মত বহু ক্ষত রয়ে গেছে ভিতরে দেয়ালে
কিছু কিছু অভিমান
ইমন-কল্যাণ।
সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভাল হতো।
পুরুষ কীভাবে কাঁদে সে-ই শুধু জানে।
কার্পেট সাজানো প্রিয় অন্তঃপুরে ঢুকে গেছে জল।
মুহুর্মুহু নৌকোডুবি, ভেসে যায় বিরুদ্ধ নোঙর।
পৃথিবীর যাবতীয় প্রেমের সপ্তডিঙা ডুবছে যেখানে
সেখানে নারীর মত পদ্ম ফুটে থাকে।
জল হাসে, জলতার চুড়িপরা হাতে,
নর্তকীর মত নেচে ঘুরে ঘুরে ঘাগরার ছোবলে
সবকিছু কেড়ে নেয়, কেড়ে নিয়ে ফের ভরে দেয়
বাসি-হয়ে-যাওয়া বুকে পদ্মগন্ধ, প্রকাণ্ড উদ্যান।
এই অপরূপ ধ্বংস, মরচে-পড়া ঘরের-দোরে চাঁপা রঙে এই চুনকাম
দরবারী কানাড়া এরই নাম ?
সরোদ বাজাতে জানলে বড় ভাল হতো।
পুরুষ কীভাবে বাঁচে সে-ই শুধু জানে।

বৃষ্টি (Bristy) - অমিয় চক্রবর্তী

বৃষ্টি
 -  অমিয় চক্রবর্তী
-------------------------

কেঁদেও পাবে না তাকে বর্ষার অজস্র জলধারে।

ফাল্গুন বিকেলে বৃষ্টি নামে।
শহরের পথে দ্রুত অন্ধকার।
লুটোয় পাথরে জল, হাওয়া তমস্বিনী;
আকাশে বিদ্যুৎজ্বলা বর্শা হানে
ইন্দ্রমেঘ;
কালো দিন গলির রাস্তায়।
কেঁদেও পাবে না তাকে অজস্র বর্ষার জলধারে।

নিবিষ্ট ক্রান্তির স্বর ঝরঝর বুকে
অবারিত।
চকিত গলির প্রান্তে লাল আভা দুরন্ত সিঁদুরে
পরায় মূহুর্ত টিপ,
নিভে যায় চোখে
কম্পিত নগরশীর্ষে বাড়ির জটিল বোবা রেখা।
বিরাম স্তম্ভিত লগ্ন ভেঙে
আবার ঘনায় জল।
বলে নাম, বলে নাম, অবিশ্রাম ঘুরে-ঘুরে হাওয়া
খুঁজেও পাবে না যাকে বর্ষায় অজস্র জলধারে।

আদিম বর্ষণ জল, হাওয়া, পৃথিবীর।
মত্ত দিন, মুগ্ধ ক্ষণ, প্রথম ঝঙ্কার
অবিরহ,
সেই সৃষ্টিক্ষণ
স্রোত:স্বনা
মৃত্তিকার সত্তা স্মৃতিহীনা
প্রশস্ত প্রচীর নামে নিবিড় সন্ধ্যায়,
এক আর্দ্র চৈতন্যের স্তব্ধ তটে।

ভেসে মুছে ধুয়ে ঢাকা সৃষ্টির আকাশে দৃষ্টিলোক।
কী বিহ্বল মাটি গাছ, দাঁড়ানো মানুষ দরজায়
গুহার আঁধারে চিত্র , ঝড়ে উতরোল
বারে-বারে পাওয়া, হাওয়া, হারানো নিরন্ত ফিরে-ফিরে-
ঘনমেঘলীন
কেঁদেও পাবে না যাকে বর্ষায় অজস্র জলধারে।

Friday, April 18, 2014

বনলতা সেন - জীবনানন্দ দাস

বনলতা সেন 

হাজার বছর ধরে আমি পথ
হাঁটিতেছি পৃথিবীর পথে,
সিংহল-সমুদ্র থেকে নিশীথের
অন্ধকারে মালয়-সাগরে
অনেক ঘুরেছি আমি; বিম্বিসার-
অশোকের ধূসর জগতে
সেখানে ছিলাম আমি; আরও দূর
অন্ধকারে বিদর্ভ নগরে;
আমি ক্লান্ত প্রাণ এক,
চারিদিকে জীবনের সমুদ্র সফেন,
আমারে দু-দন্ড শান্তি দিয়েছিল
নাটোরের বনলতা সেন ।

চুল তার কবেকার অন্ধকার বিদিশার নিশা,
মুখ তার শ্রাবস্তীর কারুকার্য; অতিদূর সমুদ্রের পর
হাল ভেঙ্গে যে নাবিক হারায়েছে দিশা
সবুজ ঘাসের দেশ যখন
সে চোখে দেখে দারুচিনি-
দ্বীপের ভিতর,
তেমনি দেখেছি তারে অন্ধকারে;
বলেছে সে, ‘এতদিন কোথায় ছিলেন?’
পাখির নীড়ের মত চোখ তুলে নাটোরের বনলতা সেন।

অদ্ভুত আঁধার এক - জীবনানন্দ দাস

অদ্ভুত আঁধার এক

অদ্ভুত আঁধার এক এসেছে এ পৃথিবীতে আজ,
যারা অন্ধ সবচেয়ে বেশি আজ
চোখে দেখে তারা;
যাদের হৃদয়ে কোনো প্রেম নেই-
প্রীতি নেই-করুনার আলোড়ন নেই
পৃথিবী অচল আজ তাদের সুপরামর্শ
ছাড়া।
যাদের গভীর আস্থা আছে আজো মানুষের
প্রতি,
এখনো যাদের কাছে স্বাভাবিক
বলে মনে হয়
মহৎ সত্য বা রীতি, কিংবা শিল্প
অথবা সাধনা
শকুন ও শেয়ালের খাদ্য আজ তাদের হৃদয়।

ফেরিওলা - হেলাল হাফিজ


ফেরিওলা
কষ্ট নেবে কষ্ট
হরেক রকম কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট !
লাল কষ্ট নীল কষ্ট কাঁচা হলুদ রঙের কষ্ট
পাথর চাপা সবুজ ঘাসের সাদা কষ্ট,
আলোর মাঝে কালোর কষ্ট
‘মালটি-কালার’ কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
ঘরের কষ্ট পরেরর কষ্ট পাখি এবং পাতার কষ্ট
দাড়ির কষ্ট
চোখের বুকের নখের কষ্ট,
একটি মানুষ খুব নীরবে নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
প্রেমের কষ্ট ঘৃণার কষ্ট নদী এবং নারীর কষ্ট
অনাদর ও অবহেলার তুমুল কষ্ট,
ভুল রমণী ভালোবাসার
ভুল নেতাদের জনসভার
হাইড্রোজনে দুইটি জোকার নষ্ট হবার কষ্ট আছে
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
দিনের কষ্ট রাতের কষ্ট
পথের এবং পায়ের কষ্ট
অসাধারণ করুণ চারু কষ্ট ফেরীঅলারকষ্ট
কষ্ট নেবে কষ্ট ।
আর কে দেবে আমি ছাড়া
আসল শোভন কষ্ট,
কার পুড়েছে জন্ম থেকে কপাল এমন
আমার মত ক’জনের আর
সব হয়েছে নষ্ট,
আর কে দেবে আমার মতো হৃষ্টপুষ্ট কষ্ট

কেউ কথা রাখেনি(keu kotha rakheni ) - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়


কেউ কথা রাখেনি
 - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
-------------------------------------
কেউ কথা রাখেনি, তেত্রিশ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
ছেলেবেলায় এক বোষ্টুমী তার আগমনী গান হঠাৎ থামিয়ে বলেছিল
শুক্লা দ্বাদশীর দিন অন্তরাটুকু শুনিয়ে যাবে
তারপর কত চন্দ্রভূক অমাবস্যা চলে গেলো, কিন্তু সেই বোষ্টুমী
আর এলোনা
পঁচিশ বছর প্রতিক্ষায় আছি।
মামা বাড়ির মাঝি নাদের আলী বলেছিল, বড় হও দাদাঠাকুর
তোমাকে আমি তিন প্রহরের বিল দেখাতে নিয়ে যাবো
সেখানে পদ্মফুলের মাথায় সাপ আর ভ্রমর
খেলা করে!
নাদের আলী, আমি আর কত বড় হবো? আমার মাথা এ ঘরের ছাদ
ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ করলে তারপর তুমি আমায়
তিন প্রহরের বিল দেখাবে?
একটাও রয়্যাল গুলি কিনতে পারিনি কখনো
লাঠি-লজেন্স দেখিয়ে দেখিয়ে চুষেছে লস্করবাড়ির ছেলেরা
ভিখারীর মতন চৌধুরীদের গেটে দাঁড়িয়ে দেখেছি
ভিতরে রাস-উৎসব
অবিরল রঙের ধারার মধ্যে সুবর্ণ কঙ্কণ পরা ফর্সা রমণীরা
কত রকম আমোদে হেসেছে
আমার দিকে তারা ফিরেও চায়নি!

আঠারো বছর বয়স - সুকান্ত ভট্টাচার্য


আঠারো বছর বয়স

আঠারো বছর বয়স কী দুঃসহ
র্স্পধায় নেয় মাথা তোলবার ঝুঁকি,
আঠারো বছর বয়সেই অহরহ
বিরাট দুঃসাহসেরা দেয় যে উঁকি।
আঠারো বছর বয়সের নেই ভয়
পদাঘাতে চায় ভাঙতে পাথর বাধা,
এ বয়সে কেউ মাথা নোয়াবার নয়–
আঠারো বছর বয়স জানে না কাঁদা।

এ বয়স জানে রক্তদানের পুণ্য
বাষ্পের বেগে স্টিমারের মতো চলে,
প্রাণ দেওয়া-
নেওয়া ঝুলিটা থাকে না শূন্য
সঁপে আত্মাকে শপথের কোলাহলে।

আঠরো বছর বয়স ভয়ঙ্কর
তাজা তাজা প্রাণে অসহ্য যন্ত্রণা,
এ বয়সে প্রাণ তীব্র আর প্রখর
এ বয়সে কানে আসে কত মন্ত্রণা।

আঠারো বছর বয়স যে দুর্বার
পথে প্রান্তরে ছোটায় বহু তুফান,
দুর্যোগে হাল ঠিক মতো রাখা ভার
ক্ষত-বিক্ষত হয় সহস্র প্রাণ।

ছাড়পত্র - সুকান্ত ভট্টাচার্য


ছাড়পত্র

যে শিশু ভূমিষ্ট হল আজ রাত্রে
তার মুখে খবর পেলুমঃ
সে পেয়েছে ছাড়পত্র এক,
নতুন বিশ্বের দ্বারে তাই ব্যক্ত
করে অধিকার
জন্মমাত্র সুতীব্র চীৎকারে।
খর্বদেহ নিঃসহায়, তবু তার মুষ্টিবদ্ধ
হাত
উত্তোলিত, উদ্ভাসিত
কী এক দুর্বোধ্য প্রতিজ্ঞায়।
সে ভাষা বুঝে না কেউ,
কেউ হাসে, কেউ করে মৃদু তিরস্কার।
আমি কিন্তু মনে মনে বুঝেছি সে ভাষা
পেয়েছি নতুন চিঠি আসন্ন যুগের-
পরিচয়-পত্র পড়ি ভূমিষ্ট শিশুর
অস্পষ্ট কুয়াশাভরা চোখে।
এসেছে নতুন শিশু,
তাকে ছেড়ে দিতে হবে স্থান;
জীর্ণ পৃথিবীতে ব্যর্থ, মৃত আর
ধ্বংসস্তুপ-পিঠে
চলে যেতে হবে আমাদের।

জন্মই আমার আজন্ম পাপ - দাউদ হায়দার

 জন্মই আমার আজন্ম পাপ

জন্মই আমার আজন্ম পাপ, মাতৃজরায়ু থেকে নেমেই জেনেছি আমি
সন্ত্রাসের ঝাঁঝালো দিনে বিবর্ণ পত্রের মত হঠাৎ ফুৎকারে উড়ে যাই
পালাই পালাই সুদূরে
চৌদিকে রৌদ্রের ঝলক
বাসের দোতলায় ফুটপাতে রুটির দোকানে দ্রুতগামী
নতুন মডেলের
চকচকে বনেটে রাত্রির জমকালো আলো
ভাংগাচোরা চেহারার হদিস
ক্লান্ত নিঃশব্দে আমি হেঁটে যাই
পিছনে ঝাঁকড়া চুলওয়ালা যুবক। অষ্টাদশ বর্ষীয়ার নিপুণ ভঙ্গী
দম্পতির অলৌকিক হাসি প্রগাঢ় চুম্বন
আমি দেখে যাই, হেঁটে যাই, কোথাও সামান্য বাতাসে উড়ে যাওয়া চাল-
অর্থাৎ আমার নিবাস।
ঘরের স্যাঁতসেতে মেঝেয় চাঁদের আলো এসে খেলা করে
আমি তখন সঙ্গমে ব্যর্থ, স্ত্রীর দুঃখ অভিমান কান্না
সন্তান সন্তুতি পঙ্গু
পেটে জ্বালা, পাজরায় তেল মালিশের বাসন উধাও-
আমি কোথা যাই? পান্তায় নুনের অভাব।
নিঃসংগতাও দেখেছি আমি, উৎকন্ঠার দিনমান জ্বলজ্বলে বাল্বের মতোন
আমার চোখের মতো স্বজনের চোখ-
যেন আমুন্ড গ্রাস করবে এই আমাকেই
আমিই সমস্ত আহার নষ্ট করেছি নিমেষে।
শত্রুর দেখা নেই, অথচ আমারি শত্রু আমি-

তোমার চোখ এতো লাল কেন(tomar choke eto lal keno) - নির্মলেন্দু গুণ


তোমার চোখ এতো লাল কেন

আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে , আমি চাই
কেউ একজন আমার জন্য অপেক্ষা করুক,
শুধু ঘরের ভেতর থেকে দরোজা খুলে দেবার জন্য ।
বাইরে থেকে দরোজা খুলতে খুলতে আমি এখন ক্লান্ত ।
আমি বলছি না ভালোবাসতেই হবে, আমি চাই
কেউ আমাকে খেতে দিক । আমি হাতপাখা নিয়ে
কাউকে আমার পাশে বসে থাকতে বলছি না,
আমি জানি, এই ইলেকট্রিকের যুগ
নারীকে মুক্তি দিয়েছে স্বামী -সেবার দায় থেকে ।
আমি চাই কেউ একজন জিজ্ঞেস করুক :
আমার জল লাগবে কি না, নুন লাগবে কি না,
পাটশাক ভাজার সঙ্গে আরও একটা
তেলে ভাজা শুকনো মরিচ লাগবে কি না ।
এঁটো বাসন, গেঞ্জি-রুমাল আমি নিজেই ধুতে পারি ।

জয়ী নই, পরাজিত নই – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

জয়ী নই, পরাজিত নই
 – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

পাহাড়-চুড়ায় দাঁড়িয়ে মনে হয়েছিল
আমি এই পৃথিবীকে পদতলে রেখেছি
এই আক্ষরিক সত্যের কছে যুক্তি মূর্ছা যায়।
শিহরিত নির্জনতার মধ্যে বুক টন্‌‌টন করে ওঠে
হাল্‌কা মেঘের উপচ্ছায়ায় একটি ম্লান দিন
সবুজকে ধূসর হতে ডাকে
আ-দিগন্ত প্রান্তের ও টুকরো ছড়ানো টিলার উপর দিয়ে
ভেসে যায় অনৈতিহাসিক হাওয়া
অরণ্য আনে না কোনো কস্তুরীর ঘ্রাণ
কিছু নিচে ছুটন্ত মহিলার গোলাপি রুমাল উড়ে গিয়ে পড়ে
ফণমনসার ঝোপে
নিঃশব্দ পায়ে চলে যায় খরগোশ আর রোদ্দুর।

এই যে মুহূর্তে, এই যে দাঁড়িয়ে থাকা–এ‌র কোনো অর্থ নেই
ঝর্নার জলে ভেসে যায় সম্রাটের শিরস্ত্রাণ
কমলার কোয়া থেকে খসে পড়া বীজ ঢুকে পড়ে পাতাল গর্ভে
পোল্‌কা ডট্‌ দুটি প্রজাপতি তাদের আপন আপন কাজে ব্যস্ত
বাব্‌‌লা গাছের শুক্‌নো কাঁটাও দাবী করেছে প্রকৃতির প্রতিনিধিত্ব।
সব দৃশ্যই এমন নিরপেক্ষ
আমি জয়ী নই, আমি পরাজিত নই, আমি এমনই একজন মানুষ
পাহাড় চূড়ায় পৃথিবীকে পদতলে রেখে, আমার নাভিমূল
থেকে উঠে আসে বিষণ্ন, ক্লান্ত দীর্ঘশ্বাস
এই নির্জনতাই আমার ক্ষমাপ্রার্থী অশ্রুমোচনের মুহূর্ত।।

পালের নাও - জসীমউদ্দীন

পালের নাও
---জসীমউদ্দীন
------------------------
পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও-
ঘরে আছে ছোট বোনটি তারে নিয়ে যাও !
কপিল-সারি গাইয়ের দুধ যেয়ো পান করে,
কৌটা ভরি সিঁদুর দেব কপালটি ভরে।
গুরার গায়ে ফুল চন্দন দেব ঘষে ঘষে,
মামা-বাড়ির বলব কথা-শুনো বসে বসে।

কে যাওরে পাল-ভরে কোন দেশে ঘর,
পাছা নায়ে বসে আছে কোন সওদাগর ?
কোন দেশে কোন গাঁয়ে হিরে ফুল ঝরে,
কোন দেশে হিরামন পাখি বাস করে।
কোন দেশে রাজ-কনে, খালি ঘুম যায়,
ঘুম যায় আর হাসে হিম-সিম বায়!
সেই দেশে যাব আমি কিছু নাহি চাই,
ছোট মোর বোনটিরে সাথে যাদি পাই।

পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও-
তোমার যে পালে নাচে ফুলঝুরি বাও-
তোমার যে নার ছই আবের ঢাকনি,
ঝলমল জ্বলিতেছে সোনার বাঁধুনি।
সোনার না’বাঁধনরে তার গোড়ে গোড়ে,
হিরামন পঙ্খির লাল পাখা ওড়ে।
তার পর ওড়েরে ঝালরের হাসি,
ঝলমল জলে জ্বলে রতনের রাশে।
এই নাও বেয়ে যায় কোন সওদাগর,
কয়ে যাও-কয়ে যাও, কোন দেশে ঘর ?

পালের নাও, পালের নাও, পান খেয়ে যাও-
ঘরে আছে ছোট বোন তারে নিয়ে যাও।
যে না গাঙে সাতধার করে গলাগলি,
সেথা বাস কুহেলির-লোকে গেছে বলি।
পারাপার দুই নদী-মাঝে বালচুর,
সেইখানে বাস করে চাঁদ-সওদাগর।
এপারে ভুতুমের বাসা ও-পারেতে টিয়া-
সে খানেতে যেয়োনারে নাওখানি নিয়া।
ভাইটাল গাঙ দোলে ভাটী গেঁয়ো সোঁতে,
হবে নারে নাও বাওয়া সেথা কোনমতে।

Thursday, April 17, 2014

তুমি আসবেই আমি জানি (tumi asbai ami jani) - কবীর সুমন

জানিনা কে দিয়েছিল পলাশকে তার ডাকনাম -
জানিনা কতটা ঘন হলে মেঘ হবে ঘনশ্যাম -
জানিনা কতটা কথা বলা হলে হবে কথকতা -
জানিনা কিভাবে স্রোত ভেঙ্গে দেয় নদীর জড়তা -
জানিনা ফুরাবে কবে বৃথা প্রশ্নের হয়রানি -
উত্তর আসবে না , তুমি আসবেই আমি জানি ।

জানিনা কোন গুনির তান পুড়ে হল তানপুরা -
জানিনা শ্রীরাধিকার প্রিয় ছিল কিনা রাধাচূড়া -
জানিনা শ্যামের বাঁশি সাঁওতালি সুরে বাজে কিনা -
জানিনা গোঠের পথ - মথুরার হদিস চিনিনা -
জানিনা ঝুলনে আজও হয় কিনা মিঠে কানাকানি -
উত্তর আসবে না , তুমি আসবেই আমি জানি ।

জানিনা তথাগতর স্তব কেন দুনিয়া বোঝেনি -
জানিনা জুডাস কেন ভালবেসে যিশুকে খোঁজেনি -
জানিনা এ পৃথিবীর ঘাতকরা গান শোনে কিনা -
জানিনা লালন শুনে ভাসে কেন বুকের আঙ্গিনা -
জানিনা বিচার হলে কেন গান হয়না শুনানি -
উত্তর আসবে না , তুমি আসবেই আমি জানি ।

জানিনা তিতুমিরের নাম কেন ব্যরিকেডে নেই -
জানিনা রামপ্রসাদ কেন ফেরে ঘনিয়ে আসছেই -
জানিনা সুমন তুমি কৃষিকাজ কেন যে জাননা -
জানিনা মানব জমি আবাদে ফলত কিনা সোনা -
জানিনা কাঁদায় কেন সহজ সুরে শয়তানি -
উত্তর আসবে না , তুমি আসবেই আমি জানি ।

জানিনা বয়স হলে কেন প্রমে এত পাক ধরে -
জানিনা হৃদয় কেন রাত জেগে পায়চারি করে -
জানিনা কোন কথার কোনখানে কোন মানে হয় -
জানিনা সমানে কেন মনে হয় হয়নি সময় -
জানিনা গিটার কেন আমার প্রেমের রাজধানী -
উত্তর আসবে না , তুমি আসবেই আমি জানি ।

কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়(kotota poth perole tobe pothik bola jay) - কবীর সুমন

কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায় -  কবীর সুমন

কতটা পথ পেরোলে তবে পথিক বলা যায়
কতটা পথ পেরোলে পাখি জিরোবে তার দায়
কতটা অপচয়ের পর মানুষ চেনা যায়
প্রশ্নগুলো সহজ, আর উত্তরও জানা।।
কত বছর পাহাড় বাঁচে ভেঙেগ যাবার আগে
কত বছর মানুষ বাঁচে পায়ে শিকল পড়ে
ক’বার তুমি অন্ধ সেজে থাকার অনুরাগে
বলবে তুমি দেখছিলে না তেমন ভালো করে।।
কত হাজার বারের পর আকাশ দেখা যাবে
কতটা কান পাতলে পরে কান্না শোনা যাবে
কত হাজার মরলে তবে মানবে তুমি শেষে,
বড্ড বেশী মানুষ গেছে বানের জলে ভেসে ।।

তোমাকে চাই(Tomake chai) - কবীর সুমন

তোমাকে চাই -  কবীর সুমন

প্রথমত আমি তোমাকে চাই
দ্বিতীয়ত আমি তোমাকে চাই
তৃতীয়ত আমি তোমাকে চাই
শেষ পর্যন্ত তোমাকে চাই
নিঝুম অন্ধকারে তোমাকে চাই
রাতভোর হলে আমি তোমাকে চাই
সকালের কৈশোরে তোমাকে চাই
সন্ধের অবকাশে তোমাকে চাই
বৈশাখী ঝড়ে আমি তোমাকে চাই
আষাঢ়ের মেঘে আমি তোমাকে চাই
শ্রাবণে শ্রাবণে আমি তোমাকে চাই
অকালবোধনে আমি তোমাকে চাই
কবেকার কলকাতা শহরের পথে
পুরোনো নতুন মুখ ঘরে ইমারতে
অগুন্তি মানুষের ক্লান্ত মিছিলে
অচেনা ছুটির ছোঁয়া তুমি এনে দিলে
নাগরিক ক্লান্তিতে তোমাকে চাই
এক ফোঁটা শান্তিতে তোমাকে চাই
বহুদূর হেঁটে এসে তোমাকে চাই
এ জীবন ভালোবেসে তোমাকে চাই
চৌরাস্তার মোড়ে পার্কে দোকানে
শহরে গঞ্জে গ্রামে এখানে ওখানে
স্টেশন টার্মিনাস ঘাটে বন্দরে
অচেনা ড্রয়িংরুমে চেনা অন্দরে
বালিশ তোশক কাঁথা পুরোনো চাদরে
ঠান্ডা শীতের রাতে লেপের আদরে
কড়িকাঠে চৌকাঠে মাদুরে পাপোশে
হাসি রাগ অভিমানে ঝগড়া আপোসে
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই, 
তোমাকে চাই, তোমাকে চাই
এক কাপ চায়ে আমি তোমাকে চাই
ডাইনে ও বাঁয়ে আমি তোমাকে চাই
দেখা না দেখায় আমি তোমাকে চাই
না-বলা কথায় আমি তোমাকে চাই

জাতিস্মর(jatiswar) - কবীর সুমন

জাতিস্মর - কবীর সুমন 

অমরত্বের প্রত্যাশা নেই নেই কোন দাবী দাওয়া
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকে চাওয়া
মুহূর্ত যায় জন্মের মতো অন্ধ জাতিস্মর
গত জন্মের ভুলে যাওয়া স্মৃতি বিস্মৃত অক্ষর
ছেঁড়া তাল পাতা পুঁথির পাতায় নিঃশ্বাস ফেলে হাওয়া
এই নশ্বর জীবনের মানে শুধু তোমাকেই চাওয়া
কাল-কেউটের ফনায় নাচছে লখিন্দরের স্মৃতি
বেহুলা কখনো বিধবা হয় না এটা বাংলার রীতি
ভেসে যায় ভেলা এবেলা ওবেলা একই শবদেহ নিয়ে
আগেও মরেছি আবার মরবো প্রেমের দিব্যি দিয়ে
জন্মেছি আমি আগেও অনেক মরেছি তোমারই কোলে
মুক্তি পাইনি শুধু তোমাকে আবার দেখবো বলে
বার বার ফিরে এসেছি আমরা এই পৃথিবীর টানে
কখনো গাঙর কখনো কোপাই কপোতাক্ষর গানে
গাঙর হয়েছে কখনো কাবেরী কখনো বা মিসিসিপি
কখনো রাইন কখনো কঙ্গো নদীদের স্বরলিপি
স্বরলিপি আমি আগেও লিখিনি এখনও লিখিনা তাই
মুখে মুখে ফেরা মানুষের গানে শুধু তোমাকেই চাই
তোমাকে চেয়েছি ছিলাম যখন অনেক জন্ম আগে
তথাগত তার নিঃসঙ্গতা দিলেন অস্তরাগে
তারই করুনায় ভিখারিনী তুমি হয়েছিলে একা একা
আমিও কাঙাল হলাম আরেক কাঙালের পেতে দেখা
নতজানু হয়ে ছিলাম তখন এখনো যেমন আছি
মাধুকরী হও নয়নমোহিনী স্বপ্নের কাছাকাছি

কথোপকথন – ১ -পূর্ণেন্দু পত্রী

-তোমার পৌঁছুতে এত দেরী হলো ?
-পথে ভিড় ছিল ?
-আমারও পৌঁছুতে একটু দেরী হলো
সব পথই ফাটা ।
-পথে এত ভিড় ছিল কেন ?
-শবযাত্রা ? কার মৃত্যু হল ?
-এই তি সেদিন যোগো গেল
-দৌড়ে গেল, এখনও ফিরল না।
-আগে পরে শঙ্কর, বিমল। 
-আমাদের যাকে যাকে প্রয়োজন তারাই পালায়---- 
-দূরের সমুদ্রে চলে যায়। 
-কালো নুলিয়ারা যে-রকম বিলীনের দিকে।
-আরও যাবে, আমরাও যাবো।
-লোকাল ট্রেনের মতো বেশ ঘন ঘন
-আসছে যাচ্ছে মৃত্যু আজকাল। 
-তোমার কেমন মৃত্যু ভাল লাগে ?
-আমি ? সেরিব্রাল ?
-মৃত্যুর কথায় রাগ হল ?
- মৃত্যুর প্রসঙ্গ তবে থাক
-জীবনের আলোচনা হোক ।

বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি -পুর্ণেন্দু পত্রী

বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি 
-----------------------------
বৃক্ষের ভাগ্যকে ঈর্ষা করি।
নিজের বেদনা থেকে নিজেই ফোটায় পুস্পদল।
নিজের কস্তুরী গন্ধে নিজেই বিহ্বল।
বিদীর্ণ বল্কলে বাজে বসন্তের বাঁশরী বারংবার
আত্মজ কুসুমগুলি সহস্র চুম্বনচিহ্নে অলংকৃত করে ওষ্ঠতল।

আমি একা ফুটিতে পারি না।
আমি একা ফোটাতে পারি না।
রক্তের বিষাদ থেকে একটি আরক্তিম কুসুমও।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।

বহুজন্ম বসন্তের অম্লান মঞ্জুরী ফুটে আছো।
নয়নের পথে দীর্ঘ ছায়াময় বনবীথিতল
ওষ্ঠের পল্লব জুড়ে পুস্প বিচ্ছুরন।
আমাকে বৃক্ষের ভাগ্য তুমি দিতে পারো।

তুমি পারো করতলে তুলে নিতে আমার বিষাদ
ভিক্ষাপাত্র ভরে দিতে পারো তুমি অমর সম্ভারে
সর্বাঙ্গ সাজিয়ে আছো চন্দ্রালোকে, চন্দনের ক্ষেত।
আমার উদগত অশ্রু অভ্যথর্না করে নিতে
পারো না কি তোমার উদ্যানে?

মোহিনীরা স্বভাবে নির্মম।
আর যারা ভালোবাসে
তারা শুধু নিজেদের আত্মার ক্রন্দনে ক্লিষ্ট হয়।
                                                  -পুর্ণেন্দু পত্রী

যে টেলিফোন আসার কথা -পুর্ণেন্দু পত্রী

যে টেলিফোন আসার কথা

যে টেলিফোন আসার কথা সে টেলিফোন আসেনি।
প্রতীক্ষাতে প্রতীক্ষাতে
সূর্য ডোবে রক্তপাতে
সব নিভিয়ে একলা আকাশ নিজের শূন্য বিছানাতে।
একান্তে যার হাসির কথা হাসেনি।
যে টেলিফোন আসার কথা আসেনি।

অপেক্ষমান বুকের ভিতর কাঁসরঘন্টা শাখেঁর উলু
একশ বনের বাতাস এসে একটা গাছে হুলুস্থুলু
আজ বুঝি তার ইচ্ছে আছে
ডাকবে আলিঙ্গনের কাছে
দীঘির পাড়ে হারিয়ে যেতে সাঁতার জলের মত্ত নাচে।
এখনো কি ডাকার সাজে সাজেনি?
যে টেলিফোন বাজার কথা বাজেনি।

তৃষ্ণা যেন জলের ফোঁটা বাড়তে বাড়তে বৃষ্টি বাদল
তৃষ্ণা যেন ধূপের কাঠি গন্ধে আঁকে সুখের আদল
খাঁ খাঁ মনের সবটা খালি
মরা নদীর চড়ার বালি
অথচ ঘর দুয়ার জুড়ে তৃষ্ণা বাজায় করতালি
প্রতীক্ষা তাই প্রহরবিহীন
আজীবন ও সর্বজনীন
সরোবর তো সবার বুকেই, পদ্ম কেবল পর্দানশীন
স্বপ্নকে দেয় সর্বশরীর, সমক্ষে সে ভাসে না।
যে টেলিফোন আসার কথা সচরাচর আসে না।

কথা আছে – সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

কথা আছে
বহুক্ষণ মুখোমুখি চুপচাপ, একবার চোখ তুলে সেতু
আবার আলাদা দৃষ্টি, টেবিলে রয়েছে শুয়ে
পুরোনো পত্রিকা
প্যান্টের নিচে চটি, ওপাশে শাড়ির পাড়ে
দুটি পা-ই ঢাকা
এপাশে বোতাম খোলা বুক, একদিন না-কামানো দাড়ি
ওপাশে এলো খোঁপা, ব্লাউজের নীচে কিছু
মসৃণ নগ্নতা
বাইরে পায়ের শব্দ, দূরে কাছে কারা যায়
কারা ফিরে আসে
বাতাস আসেনি আজ, রোদ গেছে বিদেশ ভ্রমণে।
আপাতত প্রকৃতির অনুকারী ওরা দুই মানুষ-মানুষী
দু‘খানি চেয়ারে স্তব্ধ, একজন জ্বলে সিগারেট
অন্যজন ঠোঁটে থেকে হাসিটুকু মুছেও মোছে না
আঙুলে চিকচিকে আংটি, চুলের কিনারে একটু ঘুম
ফের চোখ তুলে কিছু স্তব্ধতার বিনিময়,
সময় ভিখারী হয়ে ঘোরে
অথচ সময়ই জানে, কথা আছে, ঢের কথা আছে।
                                            -সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

চায়ের দোকানে - সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়

চায়ের দোকানে 
লণ্ডনে আছে লাস্ট বেঞ্চির ভীরু পরিমল,
রথীন এখন সাহিত্যে এক পরমহংস
দীপু তো  শুনেছি খুলেছে বিরাট কাগজের কল
এবং পাঁচটা চায়ের বাগানে দশআনি অংশ
তদুপরি অবসর পেলে হয় স্বদেশসেবক;
আড়াই ডজন আরশোলা ছেড়ে ক্লাস ভেঙেছিল পাগলা অমল
সে আজ হয়েছে মস্ত অধ্যাপক!
কি ভয়ংকর উজ্জ্বল ছিল সত্যশরণ
সে কেন নিজের কণ্ঠ কাটলো ঝকঝকে ক্ষুরে -
এখনো ছবিটি চোখে ভাসলেই জাগে শিহরণ
দূরে চলে যাবে জানতাম, তবু এতখানি দূরে ?
গলির চায়ের দোকানে এখন আর কেউ নেই
একদা এখানে সকলে আমরা স্বপ্নে জেগেছিলাম
এক বালিকার প্রণয়ে ডুবেছি এক সাথে মিলে পঞ্চজনেই
আজ এমনকি মনে নেই সেই মেয়েটিরও নাম।

Wednesday, April 16, 2014

স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল -পুর্ণেন্দু পত্রী

স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল 
পুরনো পকেট থেকে উঠে এল কবেকার শুকনো গোলাপ |
কবেকার ? কার দেওয়া ? কোন্ মাসে ? বসন্তে না শীতে ?
গোলাপের মৃতদেহে তার পাঠযোগ্য স্মৃতিচিহ্ন নেই |
স্মৃতি কি আমারও আছে ? স্মৃতি কি গুছিয়ে রাখা আছে
বইয়ের তাকের মত, লং প্লেইং রেকর্ড-ক্যাসেটে
যে-রকম সুসংবদ্ধ নথীভুক্ত থাকে গান, আলাপচারীতা ?
আমার স্মৃতিরা বড় উচ্ছৃঙ্খল, দমকা হাওয়া যেন
লুকোচুরি, ভাঙাভাঙি, ওলোটপালটে মহাখুশি
দুঃখেরও দুপুরে গায়, গাইতে পারে, আনন্দ-ভৈরবী |
আকাঙ্খার ডানাগুলি মিশে গেছে আকাশের অভ্রে ও আবীরে
আগুনের দিনগুলি মিশে গেছে সদ্যজাত ঘাসের সবুজে
প্রিয়তম মুখগুলি মিশে গেছে সমুদ্রের ভিতরের নীলে |
স্মৃতি বড় উচ্ছৃঙ্খল, দুহাজার বছরেও সব মনে রাখে
ব্যাধের মতন জানে অরণ্যের আদ্যোপান্ত মূর্তি ও মর্মর |
অথচ কাল বা পরশু কে ডেকে গোলাপ দিল কিছুতে বলবে না |
-পুর্ণেন্দু পত্রী

রাত্রি – অমিয় চক্রবর্তী

রাত্রি

অতন্দ্রিলা,
ঘুমোওনি জানি
তাই চুপি চুপি গাঢ় রাত্রে শুয়ে
বলি, শোনো,
সৌরতারা-ছাওয়া এই বিছানায়
—সূক্ষ্মজাল রাত্রির মশারি—
কত দীর্ঘ দুজনার গেলো সারাদিন,
আলাদা নিশ্বাসে—
এতক্ষণে ছায়া-ছায়া পাশে ছুঁই
কী আশ্চর্য দু-জনে দু-জনা—
অতন্দ্রিলা,
হঠাত্ কখন শুভ্র বিছানায় পড়ে জ্যোত্স্না,
দেখি তুমি নেই ||

                          -অমিয় চক্রবর্তী

বৃষ্টি ভেজা বাংলা ভাষা-জয় গোস্বামী

বৃষ্টি ভেজা বাংলা ভাষা
কে মেয়েটি হঠাৎ প্রণাম করতে এলে ?
মাথার ওপর হাত রাখিনি
তোমার চেয়েও সসংকোচে এগিয়ে গেছি
তোমায় ফেলে
ময়লা চটি, ঘামের গন্ধ নোংরা গায়ে,
হলভরা লোক, সবাই দেখছে তার মধ্যেও
হাত রেখেছ আমার পায়ে
আজকে আমি বাড়ি ফিরেও স্নান করিনি
স্পর্শটুকু রাখব বলে
তোমার হাতের মুঠোয় ভরা পুস্করিণী
পরিবর্তে কী দেব আর ? আমার শুধু
দু’ চার পাতা লিখতে আসা
সর্বনাশের এপার ওপার দেখা যায় না
কিন্তু আমি দেখতে পেলাম, রাঙা আলোয়
দাঁড়িয়ে আছে সে-ছন্দ, সে-কীর্তিনাশা ।
অচেনা ওই মেয়ের চোখে যে পাঠাল
দু’-এক পলক বৃষ্টিভেজা বাংলা ভাষা ।
                            জয় গোস্বামী

টিউটোরিয়াল – জয় গোস্বামী

তোমাকে পেতেই হবে শতকরা অন্তত নব্বই (বা নব্বইয়ের বেশি)
তোমাকে হতেই হবে একদম প্রথম
তার বদলে মাত্র পঁচাশি!
পাঁচটা নম্বর কম কেন? কেন কম?
এই জন্য আমি রোজ মুখে রক্ত তুলে খেটে আসি?
এই জন্যে তোমার মা কাক ভোরে উঠে সব কাজকর্ম সেরে
ছোটবেলা থেকে যেতো তোমাকে ইস্কুলে পৌঁছে দিতে?
এই জন্য কাঠফাটা রোদ্দুরে কি প্যাচপ্যাচে বর্ষায়
সারাদিন বসে থাকতো বাড়ির রোয়াকে কিংবা পার্কের বেঞ্চিতে?
তারপর ছুটি হতে, ভিড় বাঁচাতে মিনিবাস ছেড়ে
অটো-অলাদের ঐ খারাপ মেজাজ সহ্য করে
বাড়ি এসে, না হাঁপিয়ে, আবার তোমার পড়া নিয়ে
বসে পড়তো, যতক্ষণ না আমি বাড়ি ফিরে
তোমার হোমটাস্ক দেখছি, তারপরে আঁচলে মুখ মুছে
ঢুলতো গিয়ে ভ্যাপসা রান্নাঘরে?
এই জন্যে? এই জন্যে হাড়ভাঙা ওভারটাইম করে
তোমার জন্য আন্টি রাখতাম?
মোটা মাইনে, ভদ্রতার চা-জলখাবার
হপ্তায় তিনদিন, তাতে কত খরচা হয় রে রাস্কেল?
বুদ্ধি আছে সে হিসেব করবার?
শুধু ছোটকালে নয়, এখনো যে টিউটোরিয়ালে
পাঠিয়েছি, জানিস না, কিরকম খরচাপাতি তার?
ওখানে একবার ঢুকলে সবাই প্রথম হয়। প্রথম, প্রথম!
কারো অধিকার নেই দ্বিতীয় হওয়ার।
রোজ যে যাস, দেখিস না কত সব বড় বড়
বাড়ি ও পাড়ায়
কত সব গাড়ি আসে, কত বড় আড়ি করে
বাবা মা-রা ছেলেমেয়েদের নিতে যায়?
আর ঐ গাড়ির পাশে, পাশে না পিছনে-
ঐ অন্ধকারটায়
রোজ দাঁড়াতে দেখিস না নিজের বাবাকে?
হাতে অফিসের ব্যাগ, গোপন টিফিন বাক্স, ঘেমো জামা, ভাঙা মুখ -
দেখতে পাসনা? মন কোথায় থাকে?
ঐ মেয়েগুলোর দিকে? যারা তোর সঙ্গে পড়তে আসে?
ওরা তোকে পাত্তা দেবে? ভুলেও ভাবিস না!

পাগলী, তোমার সঙ্গে - জয় গোস্বামী

পাগলী, তোমার সঙ্গে
পাগলী, তোমার সঙ্গে ভয়াবহ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ধুলোবালি কাটাব জীবন
এর চোখে ধাঁধা করব, ওর জল করে দেব কাদা
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঢেউ খেলতে যাব দু’কদম।
অশান্তি চরমে তুলব, কাকচিল বসবে না বাড়িতে
তুমি ছুঁড়বে থালা বাটি, আমি ভাঙব কাঁচের বাসন
পাগলী, তোমার সঙ্গে বঙ্গভঙ্গ জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ৪২ কাটাব জীবন।
মেঘে মেঘে বেলা বাড়বে, ধনে পুত্রে লক্ষ্মী লোকসান
লোকাসান পুষিয়ে তুমি রাঁধবে মায়া প্রপন্ঞ্চ ব্যন্জ্ঞন
পাগলী, তোমার সঙ্গে দশকর্ম জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দিবানিদ্রা কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে ঝোলভাত জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে মাংসরুটি কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নিরক্ষর জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে চার অক্ষর কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে বই দেখব প্যারামাউন্ট হলে
মাঝে মাঝে মুখ বদলে একাডেমি রবীন্দ্রসদন
পাগলী, তোমার সঙ্গে নাইট্যশালা জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে কলাকেন্দ্র কাটাব জীবন।
পাগলী, তোমার সঙ্গে বাবুঘাট জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে দেশপ্রিয় কাটাব জীবন
পাগলী, তোমার সঙ্গে সদা সত্য জীবন কাটাব
পাগলী, তোমার সঙ্গে ‘কী মিথ্যুক’ কাটাব জীবন।

অকর্মার বিভ্রাট - শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

অকর্মার বিভ্রাট
------------------
লাঙল কাঁদিয়া বলে ছাড়ি দিয়ে গলা,
তুই কোথা হতে এলি ওরে ভাই ফলা?
যেদিন আমার সাথে তোরে দিল জুড়ি
সেই দিন হতে মোর মাথা-খোঁড়াখুঁড়ি।
ফলা কহে, ভালো ভাই, আমি যাই খসে,
দেখি তুমি কী আরামে থাক ঘরে ব’সে।
ফলাখানা টুটে গেল, হল্‌খানা তাই
খুশি হয়ে পড়ে থাকে, কোনো কর্ম নাই।
চাষা বলে, এ আপদ আর কেন রাখা,
এরে আজ চালা করে ধরাইব আখা।
হল্‌ বলে, ওরে ফলা, আয় ভাই ধেয়ে—
খাটুনি যে ভালো ছিল জ্বলুনির চেয়ে।

উৎসর্গ - শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

                    উৎসর্গ


ক্ষণিকারে দেখেছিলে
ক্ষণিক বেশে কাঁচা খাতায় ,
সাজিয়ে তারে এনে দিলেম
ছাপা বইয়ের বাঁধা পাতায় ।
আশা করি নিদেন - পক্ষে
ছ'টা মাস কি এক বছরই
হবে তোমার বিজন - বাসে
সিগারেটের সহচরী ।
কতকটা তার ধোঁয়ার সঙ্গে
স্বপ্নলোকে উড়ে যাবে—
কতকটা কি অগ্নিকণায়
ক্ষণে ক্ষণে দীপ্তি পাবে ?
কতকটা বা ছাইয়ের সঙ্গে
আপনি খসে পড়বে ধুলোয় ,
তার পরে সে ঝেঁটিয়ে নিয়ে
বিদায় কোরো ভাঙা কুলোয় ।

শ্রীরবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
পৃষ্ঠা(4)1234 পরবর্তী